শিরোনাম:
ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

Shikkha Bichitra
বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯
প্রথম পাতা » তথ্য-প্রযুক্তি » ডিজিটাল নিরাপত্তা
প্রথম পাতা » তথ্য-প্রযুক্তি » ডিজিটাল নিরাপত্তা
৩৯৪৮ বার পঠিত
বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

ডিজিটাল নিরাপত্তা

রাশেদুল ইসলাম, মহাপরিচালক, ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগরাশেদুল ইসলাম: সেদিনের অনুষ্ঠানে আমি একটা ভুল কথা বলি । তারিখ ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ । ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ক একটি অনলাইন কোর্সের শুভ উদ্বোধন ছিল সেদিন । সেখানে আমি বলি, সাধারণ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে, একজন ব্যক্তিবিশেষ যতই সতর্ক থাকুন; তিনি মোটেও নিরপদ নন । কারণ, যত সতর্কই থাকুন না কেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে, একজন ব্যক্তিবিশেষ সহজেই যে কোন বিপদে আক্রান্ত হতে পারেন । কিন্তু, ডিজিটাল অপরাধের ক্ষেত্রে চিত্রটি ভিন্ন । যিনি নিরাপদ ডিজিটাল উপকরণ ব্যবহার জানেন এবং সতর্ক থাকেন; তিনি ডিজিটাল উপকরণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটা নিজস্ব নিরাপত্তা বলয় তৈরি করতে পারেন । এ ব্যবস্থায় তিনি নিজে এবং নিজের প্রতিষ্ঠানকে প্রায় শতভাগ নিরাপদ রাখতে পারেন । অনুষ্ঠানে মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপক দুজনের একজন জনাব তারেক এম বরকতউল্লাহ আমার কথার ভিন্নমত পোষণ করেন । তিনি জানান, চলমান ব্যবস্থায় ডিজিটাল উপকরণ ব্যবহারকারি কারো একার পক্ষে ডিজিটাল নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা সম্ভব নয় । তবে, একটা ইকোসিস্টেম তৈরি করা গেলে, এ সমস্যার সমাধান মিলতে পারে । অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সরকারের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জনাব জুনায়েদ আহমেদ পলক তাঁর বক্তব্যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলের মধ্যে যারা ইতোমধ্যে হ্যাকিং এর শিকার হয়েছেন, তাঁদের হাত তুলতে বলেন । তিনি নিজে এবং অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজি ) জনাব মোঃ আবুল কালাম আজাদসহ মাত্র ৭ জন হাত উঁচু করেন । তারমানে আমিসহ সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত শতাধিক অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আর কেউ ইতিপূর্বে সাইবার হ্যাকিং এর শিকার হননি । মাননীয় প্রধান অতিথি তখন জানান, বর্তমানের ডিজিটাল জামানায় দুধরণের বোকা আছেন । একদল যারা হাত উঁচু করেছেন তাঁদের মত; যারা জানেন ইতোমধ্যে তাঁরা হ্যাকিং এর শিকার হয়েছেন । আর অন্য একদল বোকা আছেন, যারা হ্যাকিং এর শিকার হয়েছেন; কিন্তু এখনও নিজেরা জানেন না যে, তাঁরা হ্যাকিং এর শিকার হয়েছেন । তারমানে ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ক জ্ঞানে আমি নিজে শেষোক্ত বোকাদলের একজন ।

ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ে আমি নিজে বোকাদলের একজন হলেও এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কিন্তু আমার মত নয় । তারা ডিজিটাল বাংলাদেশের সন্তান । পৃথিবী এখন তৃতীয় বিপ্লবের শেষ পর্যায়ে । বাংলাদেশে তৃতীয় বিপ্লবের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু বেশ দেরীতে । ২০০৯ সালে । ‘রুপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে । তবে, দেরিতে হলেও ‘রুপকল্প ২০২১’ এর আওতায় ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ কর্মকাণ্ডের বিস্ময়কর সাফল্য, গোটা পৃথিবীকে চমকে দিয়েছে বাংলাদেশ । এই সাফল্য পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাথে সমান তালে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবে অংশ নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশকে । যৌক্তিকতা প্রদর্শনের আগে এ বিষয়ের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটগুলো পর্যালোচনা করা বোধহয় জরুরী । আমার মনে হয় সেদিকটাই আগে দেখা দরকার ।

১ম শিল্প বিপ্লবের সূচনা করে গ্রেট ব্রিটেন । ১৭৬৫ সালে । স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস ওয়াটের স্টিম ইঞ্জিন শিল্পপণ্য উৎপাদনে ব্যবহার ১ম শিল্পবিপ্লবের কারণ ঘটায় । যখন ইঞ্জিন দিয়ে মেশিন চালিয়ে শিল্পপণ্য উৎপাদন শুরু হয়; তখনই ১ম শিল্প বিপ্লবের শুরু । তখন বাংলাদেশের অবস্থান কোথায় ছিল ? সকলেরই জানা ১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীন নবাবের পতন হয়েছে । ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার দেওয়ানী বা খাজনা আদায়ের ক্ষমতা পেয়েছে । ঢাকার মসলিন কারিগরদের বুড়ো আঙুল কেটে দিয়ে মসলিন উৎপাদন বন্ধ করা হয়েছে । কাপড়সহ সব ধরণের পণ্যের বাজার ব্রিটিশ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে ।

২য় শিল্পবিপ্লব শুরু ১৮৭০ সালে । ব্রিটিশ বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডের বিদ্যুৎ দিয়ে । যখন বিদ্যুৎশক্তি শিল্পপন্য উৎপাদনে ব্যবহার শুরু হয়, তখনই ঘটে ২য় শিল্পবিপ্লব । পূর্ববঙ্গীয় রেলপথ চালু হয় ১৮৫৭ সালে; অর্থাৎ, ১ম শিল্প বিপ্লবের শেষের দিকে । ২য় শিল্প বিপ্লবের আওতায় রেলপথ আরও সম্প্রসারিত হয় । কিন্তু, তা বাংলার উন্নতির জন্য নয় । বাংলা থেকে শিল্পের কাঁচামাল যোগান পাওয়াসহ ব্রিটিশ পণ্য বাজারজাত করার স্বার্থে । ফলে, ১ম ও ২য় শিল্পবিপ্লব তৎকালীন বাংলা তথা ভারত উপমহাদেশকে বাড়তি কোন সুবিধা দেয়নি । বরং, এই দুটি বিপ্লব এ দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি ব্রিটিশ শোষণের মাত্রা বাড়িয়েছে। ১ম শিল্প বিপ্লবে ইংরেজদের একচেটিয়া আধিপত্য থাকলেও ২য় শিল্প বিপ্লবে এ চিত্র পাল্টে যায় । ইতিমধ্যে শিল্পপণ্য বাজারজাত প্রতিযোগিতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি ফ্রান্সসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশ যোগদান করেছে । আর, এই বাজারদখল প্রতিযোগিতা থেকেই ১৯১৪ সনে প্রথম এবং ১৯৩৯ সনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ভারত এবং পাকিস্তানের মত স্বাধীনতাকামী অনেক দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তি তরান্বিত করে । যদিও বাংলাদেশ পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভুক্তির কারণে সে সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয় ।

কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট আবিস্কার হয় ৬০ এর দশকে । এই আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তির যুগ শুরু হলেও শিল্পপন্য উৎপাদনে এর ব্যবহার শুরু ১৯৬৯ সালে । অর্থাৎ, কম্পিউটার ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা ৩য় শিল্প বিপ্লবের সূচনা করে ১৯৬৯ সালে । অনেকেরই জানা, বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে তখন গণঅভ্যুত্থান চলমান, যা ‘ঊনসত্তর এর গণঅভ্যুত্থান’ নামে পরিচিত। জীবনমৃত্যুর মুখোমুখি তখন বঙ্গবন্ধুসহ ৩৪ জন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি । সেদিনের গণঅভ্যুত্থান স্বৈরশাসক ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খানের পতন, ১৯৭০ এর নির্বাচন এবং সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় নিশ্চিত করে । কিন্তু, নির্বাচনে বিজয়ী দলকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু এবং একই সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন । যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপ একটি দেশের ক্ষমতা গ্রহন করেন তিনি । কিন্তু, এতকিছুর মধ্যেও দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিল্প বিপ্লবের ক্রমবিবর্তনের পবরতী নিয়ামক যে তথ্যপ্রযুক্তি, তা অনুধাবন করেন ঠিকই । আর তাই, ১৯৭৩ সালেই ITU (International Telecomunication Union) এর সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশ এবং তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সনের ১৪ জুন বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করেন তিনি । কিন্ত, দুঃখজনকভাবে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বঙ্গবন্ধু । আর, এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের কর্মকাণ্ড থেমে যায় । ফলে, ‘৮০ দশকের মাঝামাঝি যখন তৃতীয় শিল্প বিপ্লবকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশ সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান ও দক্ষিন কোরিয়া অর্থনৈতিক উন্নয়নে এশিয়ার উদীয়মান বাঘ (emerging tigers) এ পরিণত হয়; বাংলাদেশ সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় ।

আগেই বলেছি বাংলাদেশ ৩য় শিল্প বিপ্লবে যোগ দেয় ২০০৯ সনে । আওয়ামী লীগ সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার মাধ্যমে । বলা যায় ৩য় শিল্প বিপ্লবের শেষ ট্রেনের যাত্রী বাংলাদেশ। তারপরও সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা, ব্যতিক্রমধর্মী বাস্তবায়ন পদ্ধতি (bottom up approach), মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদক্ষ নেতৃত্ব, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ- সবকিছু মিলিয়ে ৩য় শিল্পবিপ্লব স্বল্পতম সময়ে বাংলাদেশকে অসামান্য সাফল্য এনে দিয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন কোন স্বপ্ন নয় । বাস্তবতা । এই বাস্তবতায় বিগত ১০ বছরে একটি চমৎকার ডিজিটাল প্লাটফরম তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে । কিন্তু প্রশ্ন, এই প্লাটফরম দিয়ে অন্যান্য দেশের সাথে সমান তালে ৪র্থ শিল্পবিপ্লবে অংশ নিতে বাংলাদেশ কি সক্ষম ? এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের স্বরূপ ব্যাখ্যা করা দরকার ।

পূর্বের আলোচনায় দেখা গেছে শিল্প উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নতুন একটি প্রযুক্তি যোগ হওয়ায় উৎপাদন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এসেছে এবং সেই ব্যাপক পরিবর্তন বিপ্লবের কারণ ঘটিয়েছে । সে রকম একটা নতুন প্রযুক্তির নাম Artificial Intellegence (AI) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা । উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারই ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের মূল কারণ । অন্য ৩ টি শিল্প বিপ্লবের সাথে শেষোক্ত শিল্প বিপ্লবের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে । অন্য তিনটি শিল্প বিপ্লবে মেশিনের পিছনে কাজ করেছে মানুষ । কিন্তু ৪র্থ শিল্প বিপ্লবে মেশিনের পিছনে কাজ করবে মানুষ নয়; কাজ করবে আর একটি মেশিন । যেমনঃ গাড়ি চালাবে রোবট । আর একটি যন্ত্র । কোন মানুষ নয় । এ কারণে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে 2nd Machine Age বা ২য় যন্ত্রযুগ বলা হচ্ছে । এখানে কয়েকটি প্রশ্ন । এই দ্বিতীয় যন্ত্রযুগের জন্য বাংলাদেশ কি প্রস্তুত ? যে ডিজিটাল নিরাপত্তাহীনতার আশংকা মাননীয় প্রতিমন্ত্রী প্রকাশ করেছেন, তার নিরাপত্তা বিধানে কি বাংলাদেশ সক্ষম ? এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের মত জনবহুল একটি দেশে ৪র্থ শিল্প বিপ্লব কোন সুফল বয়ে আনবে কি ?

প্রকৃতপক্ষে ৪র্থ শিল্প বিপ্লব গোটা পৃথিবীকে একই প্লাটফরমে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে । হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রফেসর Gerschenkron এর The Gerschenkron’s Hypothesis এখানে প্রযোজ্য । এই তত্ত্বের মর্ম অনুযায়ী নিম্নবর্ণিত ৩টি শর্ত পূরণ করলে যে কোন উন্নয়নশীল দেশ ৪র্থ শিল্প বিপ্লবে বিজয়ী হতে পারেঃ

(১) যে জাতির একটা অভিজাত শ্রেণি আছে, যারা নতুন প্রযুক্তি বোঝেন;

(২) যে জাতির মধ্যে নতুন প্রযুক্তি বিরোধী কোন দল নেই; এবং

(৩) যে জাতির রাষ্ট্রক্ষমতায় দৃঢ়চেতা একজন নেতা আছেন, যিনি নতুন প্রযুক্তি গ্রহন করতে চান ।

বাংলাদেশের অভিজাত শ্রেণি শুধু যে নতুন প্রযুক্তি বোঝেন তা নয়; এদেশের আপামর জনগণ নতুন প্রযুক্তি বোঝেন । ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করার কৃতিত্ব সরকারের । এদেশে নতুন প্রযুক্তি গ্রহন বিষয়ে কোন বিরোধী দল নেই । এদেশের সরকার প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে বদ্ধপরিকর । ফলে, প্রফেসর Gerschenkron এর ধারণামতে ৪র্থ শিল্পবিপ্লব বাংলাদেশের জন্য এককথায় আশীর্বাদ স্বরূপ । তবে, ৪র্থ শিল্পবিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি হবে মানুষের মেধা এবং উদ্ভাবনী শক্তি । আর এখানেই আশা এবং শঙ্কা - দুটোই রয়েছে । আশার কথা এই যে, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের মেধা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতার অভাব নেই । আমি নিজে একটি কমিটির আহবায়ক । সরকারের এই কমিটি তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ডে অনুদান প্রদান করে থাকে । কয়েকমাস আগে সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্র আমাদের ইনোভেশন কমিটির সামনে আসে । নাম মাশফি । ছেলেটি উদ্ধারকারী একটা দ্রোন (Drone) বানাতে চায় । তার বক্তব্যে সে রানা প্লাজার দুর্ঘটনার কথা বলে । বনানীর বহুতল ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সময় উদ্ধার কাজের ট্রাজেডির কথা বলে । এই দুটি ঘটনা তাকে এই দ্রোন উদ্ভাবনে উদ্বুদ্ধ করেছে বলে সে জানায় । তার দ্রোন দুর্ঘটনা কবলিত জানমালের বাস্তব অবস্থা জানাতে সক্ষম হবে বলে দাবী করে সে । প্রশ্নোত্তর পর্বে কমিটির একজন সদস্য বনানী অগ্নিকাণ্ডের তাপমাত্রা এবং সেই আগুনে তার দ্রোন পুড়ে যাবে কিনা জানতে চান । ছেলেটি দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে বনানী অগ্নিকাণ্ডের সময় আগুনের তাপমাত্রা উল্লেখ করে এবং যে ধাতু দিয়ে তার দ্রোন তৈরি হবে, তা সেই আগুনের তাপমাত্রায় পুড়বে না বলে জানায় । ‘রুপকল্প ২০২১’ এর আওতায় ইতোমধ্যে প্রস্তুত ডিজিটাল বাংলাদেশ প্লাটফরমে এ ধরণের হাজার হাজার মাশফির গর্বিত মা এখন বাংলাদেশ । তবে, ডিজিটাল বাংলাদেশে বিভিন্ন ভাবে ছড়িয়ে থাকা এ ধরণের প্রতিভা যথাযথ কাজে লাগানো একটা বড় চ্যালেঞ্জ ।

আর আশংকার কথা এই যে, ৪র্থ শিল্প বিপ্লবে মানুষের মেধা এবং উদ্ভাবনী শক্তির একটা বড় অংশ ব্যয় হবে ডিজিটাল ব্যবস্থাকে নিরাপত্তাহীন করার কাজে । তবে, এ বিষয়ে সরকার আগেই সচেতন । ইতিপূর্বে মহান জাতীয় সংসদে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮’ পাশ হয়েছে । এই আইনের আওতায় ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি গঠিত হয়েছে । বিধিমালা চূড়ান্ত হলে এজেন্সির আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড শুরু হবে । ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির আওতায় সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থা/ এজেন্সির সমন্বয়ে জাতীয় CIRT গঠিত হলে একটা ডিজিটাল নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা সম্ভব হবে । তবে, ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন এ বিষয়ে সচেতনতা । ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি এবং এটুআই এর যৌথ পরিচালনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ক যে অনলাইন প্রশিক্ষণ কোর্সের কথা এখানে বলা হয়েছে, সেটি সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারীদের জন্য বলা হলেও- শ্রেণি-পেশা-বয়স ভেদে যে কেউ এই প্রশিক্ষণের সুযোগ নিতে পারেন । এই প্রশিক্ষণ শেষে ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ক একটা স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যেতে পারে । (www.muktopaath.gov.bd)

শেষ প্রশ্ন । বাংলাদেশের মত জনবহুল দেশে ৪র্থ শিল্পবিপ্লব কোন সুফল বয়ে আনবে কি ? উত্তরে বলা যায়, সার্বিক বিবেচনায় ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের বল এখন বাংলাদেশের কোর্টে । যে সদিচ্ছা এবং প্রতিশ্রুতি নিয়ে বর্তমান সরকার এগিয়ে চলেছে; সুষ্ঠু পরিকল্পনামাফিক একই গতিতে এগিয়ে গেলে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল ঘরে তোলা কঠিন কিছু নয় । ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের শুরুতে হাজার হাজার গার্মেন্টস শ্রমিকের চাকুরী হারানোর ভয় আছে সত্য; আবার এটাও সত্য এদেশের ডিজিটাল সন্তানদের কেউ যখন ‘কাজের বেটি সখিনা’ নামের একটা রোবট বাজারে ছাড়তে সক্ষম হবে; তখন এই রোবট শিল্পে হাজার হাজার ডিজিটাল সন্তানের কর্মসংস্থান হবে । এখানে ঝুঁকি আছে; আবার অপার সম্ভাবনাও আছে । কতটা ঝুঁকি আছে সেটা যেমন জানা দরকার; ৪র্থ শিল্প বিপ্লবে কত ধরনের সুযোগের জানালা খুলবে, সেটাও জানা দরকার । এদেশের ডিজিটাল সন্তানেরা যেন সকল সুযোগ প্রাপ্তির যোগ্যতা অর্জন করতে পারে এবং তার সদ্ব্যবহার করতে পারে- সেদিকেই বেশী গুরুত্ব দিতে হবে । যে ডিজিটাল নিরাপত্তাহীনতার কথা এখানে বলা হয়েছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ । বলা হয়ে থাকে মৌসুমি ফলে, মৌসুমি রোগ নিরাময়ের উপাদান থাকে । সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় ডিজিটাল সমাজ একটা ‘মৌসুমি ফল’ । আমরা বড়রা কেউ ডিজিটাল সন্তান নই । তাই আমাদের মনে হয় ডিজিটাল নিরাপত্তাহীনতার কোন নিশ্চিত প্রতিকার নেই । কিন্তু, এ দেশের ডিজিটাল সন্তানদের চিন্তা এক রকম নয় । ডিজিটাল নিরাপত্তা, উদ্ভাবন ও অন্যান্য বিষয়ে এদশের ডিজিটাল সন্তানদের মেধাকে কাজে লাগাতে হবে । ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সিসহ অন্যান্য সংস্থা সুপরিকল্পিত ভাবে এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে । তাহলেই ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল নেয়া এবং তারই ধারাবাহিকতায় ২০৪১ সালের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো বাংলাদেশের জন্য সহজতর হতে পারে ।

লেখকঃ মহাপরিচালক, ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ



আর্কাইভ